বগুড়া জেলার ইতিহাস হাজার বছরেরও পুরনো এবং এটি একসময় প্রাচীনবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। বগুড়ার স্থাপত্য এবং প্রত্যতাত্ত্বিক নিদর্শন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি সমৃদ্ধ অংশ বহন করে। বগুড়া জেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, কারণ এখানকার প্রতিটি স্থানে ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়কে তুলে ধরে।
আজ আমরা বগুড়া জেলার শীর্ষ আট দর্শনী স্থান সম্পর্কে জানবো যা বগুড়াকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের মূল আকর্ষণদের পোস্টটি উপকারে লাগে তারা অবশ্যই আমাদের ওয়েবসাইটে ভালোভাবে ঘুরে দেখবেন। তো চলুন আর সময় নষ্ট না করে মূল আলোচনায় ফিরে যাই।
১ । খেরুয়া মসজিদঃ
প্রথমে আমরা দেখবো – খেরুয়া মসজিদ বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলায় অবস্থিত মসজিদের সামনের দেয়ালে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায়। 1582 খ্রিস্টাব্দের মুঘল শাসক নবাব মুরাদ খান কর্তৃক নির্মিত হয় খেরুয়া মসজিদ অর্থাৎ 2024 সালে এই মসজিদের বয়স 442 বছর।
মসজিদটি দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য শিল্পিক নির্মাণ কৌশল একে মোঘল স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শনে পরিণত করেছে। মসজিদটিতে আছে চারকোনার প্রকাণ্ড আকারের মিনার এবং চওড়া দেয়ালের কারণে মসজিদের দেয়ালের গাঁথনি গুলো অসম্ভব।
নান্দনিক মিনার গম্বুজ নকশা ও ইটের বৈচিত্রময় গাঁথনিতে গোটা মসজিদ নজর কাড়ে। মসজিদের সামনের অংশের দেয়ালে ফুল ও লতাপাতা খোদাই করা নকশা আছে। প্রাচীন এই মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করা হয়, তাছাড়া প্রত্যত্ন অধিদপ্তর ।
মসজিদটি সীমানা প্রাচীর তৈরি করে দেওয়ার কারণে মসজিদের পরিবেশটি খুব সুন্দর আছে।
বগুড়া শহর থেকে 10 কিলোমিটার দূরে গোকুলমেদ,এরপরেই মহাস্থানঘর। সাথে গাড়ি বা সিএনজি থাকলে পুরো এরিয়াটা ঘুরে দেখতে সুবিধা হবে।
২ । বেহুলার বাসরঘরঃ
গোকুল মেধ যা বেহুলার বাসরঘর নামেও পরিচিত এর সঙ্গে জড়িত আছে মনসা দেবীর পূজা এবং বেহুলার লক্ষিন্দরের কাহিনী কথিত আছে। চম্পাইনগরে চাঁদ সওদাগর নামে এক ব্যবসায়ী ছিলেন। যদি তিনি মনসা পূজা দেন তাহলে ত্রিলোকে মনসার পূজা প্রচলিত হবে, তবে পুরোপুরি মনসা বিদ্যাসী ছিল চাঁদ সওদাগর তাই সে আর রাজি হলো না। চাঁদ সওদাগর সিংহল বাণিজ্য শেষ করে ফিরছিলেন।
তখন কালিদা সাগরে মনসা দেবী ঝড় সৃষ্টি করে সবগুলো জাহাজ পানিতে তলিয়ে গেলেও প্রাণে বেঁচে যান চাঁদ সওদাগর। ওই সময় চাঁদ সৌদাগরের এক পুত্র সন্তান জন্ম নেয় যার নাম লক্ষিন্দর। একে গণক ভবিষ্যৎ করে বলেন, বাসর ঘরে লক্ষিন্দরকে সাপ কামড়াবে।
লক্ষিন্দর প্রাপ্তবয়স্ক হলে, বেহুলার সাথে তার বিয়ে ঠিক করা হয় তাদের জন্য তৈরি করা হয় লোহার বাসর ঘর। বাসর রাতে অনেক নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও মনসা দেবী সুতার আকার ধারণ করে বাসর ঘরে প্রবেশ করে এবং লক্ষিন্দরকে দংশন করে সে যুগে সাপের কামড়ে কেউ মারা গেলে দাহ না করে ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হতো। লক্ষিন্দরের সাথে ভাসিয়ে দেওয়া হলো বেহুলাকেও ছয় মাস ধরে জলে ভাসতে ভাসতে এ গ্রাম থেকে সে অন্য গ্রামে গেল একসময় পচন্দর শুরু হলো লক্ষিন্দরের দেহে।
বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা করতে থাকে স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে। একসময় ভেলাটি এসে ঠেকে একটি গ্রামের ঘাটে। সে গ্রামে বাস করতো মনসার পালক মাতা নিতা। নিতা ঘাটে বসে দেখতে লাগলো মনসার কাছে ভক্ত বেহুলের প্রার্থনা তার মন গলে গেল। অবশেষে নিতা অলৌকিক ক্ষমতা বলে বেহুলা ও মৃত লক্ষিন্দরকে স্বর্গে উপস্থিত করল। চোখ খুলে বেহুলা দেখতে পেল মনসাকে মনসা বলে উঠলে্ তুমি তোমার স্বামীকে ফিরে পাবে তবে শর্ত হচ্ছে,তোমার শ্বশুরকে আমার পূজারী করতে হবে।
বেহুলা উত্তর দিল আমি পারবো। মা সাথে সাথে চোখ মেলে তাকালো লক্ষিন্দর নিতার সাহায্যে আবার মরতে ফিরে এলো বেহুলা। বেহুলা তার শ্বশুরকে সব ঘটনা খুলে বলল, এরপর চাঁদ সওদাগরের পক্ষে মনসা পূজায় না বলা আর সম্ভব হলো না। বগুড়ার গোকুলমেদ নামক স্থানটি বেহুলার বাসরঘর অথবা লক্ষিন্দরের মেদ নামেও পরিচিত।
1934 থেকে 1936 সালে এনজি মজুমদার কর্তৃক খননের ফলে এখানে একটি বিশাল মন্দিরের বা স্তুূপের ভিত্তি উন্মোচিত হয়। বেহুলার বাসর ঘরে 172 টি কুঠুরি বিভিন্ন তলে মাটি দিয়ে ভরাট করে নিচ থেকে উপরের দিকে ক্রমরাসমান করে।এমন ভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে এগুলো কোন সুউচ্চ মন্দির বা স্তুূপের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। বেহুলার বাসরঘর একটি অকল্পনীয় মনুমেন্ট।বর্তমান গবেষকদের মতে এ মনুমেন্ট 809 থেকে 847 খ্রিস্টাব্দে দেবপাল নির্মিত একটি বৈধ মাঠ।
৩ । ডিবিঃ
1970 সালে এই ডিবি বা ভিটাতে খননকার্য করে একটি মন্দির এবং তার সাথে ছোট ছোট কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়। এ ডিবির উপরিভাগে গ্রানাইট পাথরের একটি বিশাল চৌকাট পাওয়া যায় এবং তা থেকে স্থানীয় জনগণ ডিবির এমন অদ্ভুত নাম রাখে।
এখানে খননকার্য করে একই শাড়িতে আসীন অবস্থায় তিনটি বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। এখনো মাটির নিচে চাপা পড়াঅবস্থায় আছে প্রত্যস্থলটির কাঠামোর ধ্বংসবশেষ। শুধু বিশাল চৌকাটি এখানে দেখা যায় এই ভিটার ধ্বংসাবশেষ পাল শাসন আমলের প্রথম দিকের। এটি দীর্ঘকার এবং চৌকানাকৃতির মশ্রিন পাথর যা সাধারণত প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, পরশুরাম এটি সংগ্রহ করে মসরিন করে বলি দেয়ার কাজে ব্যবহার করতেন। হিন্দু রমণীগণ এ পাথর দুধ ও সিঁদুর দিয়ে স্নান করাতো।
৪ । জিয়ত কুন্ড:
জিয়ত কুন্ড প্রায় 2300 বছরের পুরনো বলে ধারণা করা হয়। জিয়তকুন্ডের নির্মাণকাল সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি তবে ইতিহাসবিদগণ মনে করেন রাজা পরশুরামের শাসনামলে তার দ্বারাই এই কূপটি খনন করা হয়েছিল।সে অনুসারে এই কূপটি খনন করা হয় 1800 থেকে 1900 শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন পরশুরামের প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল।
কথিত আছে, এই কূপের পানিতে অলৌকিক ক্ষমতা ছিল যা পান করলে মৃতরাও জীবিত হয়ে উঠতো। রাজা পরশুরাম যখন শাহ সুলতান বল্খীর সাথে যুদ্ধ করছিলেন তখন তিনি এই কূপের পানির সাহায্যে মৃত সৈনিকদের জীবিত করতেন। এই গোপন খবর শাহ সুলতান শোনার পর তিনি একটি চিলের সাহায্যে এক টুকরো গরুর মাংস এই কূপের পানিতে ফেলে দেন। এরপর থেকে এই কূপের পানির অলৌকিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তারপর শাহ সুলতান যুদ্ধে জয় লাভ করেন।
৫ । মহস্থানগড়ঃ
মহস্থানগড় দুর্গনগরীর প্রাচীরের অদূরে করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। গোবিন্দ ভিজা নামক একটি অসমতল ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ খনন চালিয়ে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। মন্দিরটিতে একাধিকবার পুনঃনির্মাণের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। এ প্রত্নস্থলের পূর্ব ও উত্তর-পার্শ্ব দিয়ে করতোয়া নদী প্রবাহিত।
গোবিন্দ ভিটায় 1960 সালে গভীর খাত খননের ফলে আবিষ্কৃত হয়। মৌর্য যুগের ছাপাঙ্কিত ও ঢালাই করা রোপ্যমুদ্রা পোড়া মাটির মূর্তি ও খেলনা এবং আরো অনেক নিদর্শন।
৬ । দুর্গ প্রাচীরঃ
দুর্গ প্রাচীরটি প্রথম নির্মিত হয়েছিল। প্রাচীন মূর্য যুগের সময় এটি মূর্য ও পাল রাজত্বের সময়কালীন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা কাঠামো হিসেবে ব্যবহৃত হতো।মহাস্থানগড় দুর্গ প্রাচীরের বিভিন্ন অংশ পরবর্তীতে পাল যুগে সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। প্রাচীরটি মূলত বাইরের সীমা নির্ধারণ এবং আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য নির্মিত হয়েছিল। এটি বিভিন্ন যুদ্ধ এবং প্রতিরক্ষা কর্মকাণ্ডের সময় রক্ষা কবজ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
মহাস্থানগড়ের প্রাচীরটি এককভাবে বিশাল পাথরের প্রাচীর যা বিভিন্ন সময় সংস্কারিত হয়েছে। এই প্রাচীরের দৈর্ঘ্য প্রায় 4000 মিটার এবং বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন উচ্চতা রয়েছে। প্রাচীরের বিভিন্ন অংশে গেট টাওয়ার এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা স্থাপনার অবশেষেও দেখা যায়। মহস্থানগড়ের দুর্গ প্রাচীর বাংলার সামরিক কৌশল এবং এবং স্থাপত্য শৈলীর এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
৭ । জাদুঘরে মস্তানগড়:
জাদুঘরে মস্তানগড় ও আশেপাশের অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা অসংখ্য প্রত্নবস্তুর নমুনা রয়েছে। মৌর্য গুপ্ত পাল ও অন্যান্য রাজবংশের অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন এখানে যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত আছে। জাদুঘরের বেশ পুরনো মাটির মূর্তি বাসনপত্র স্বর্ণবস্তু ব্রঞ্জের সামগ্রী কালো পাথরের মূর্তি বেলে পাথরের মূর্তি নানা ধরনের প্রাচীন অলংকার সহ বহু প্রাচীন ও মূল্যবান নিদর্শন রয়েছে।
৮ । ভাসুবিহার:
স্থানীয়ভাবে পরিচিত নরপতির ধাপ নামে এর অবস্থান শিবগঞ্জ উপজেলার বিহারহা। এখানে 1973 থেকে 1974 সালে প্রথমবারের মতো প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয় এবং তা পরবর্তী দুই মৌসুম অব্যাহত থাকে। ধারণা করা হয়, এটি একটি বৌদ্ধ সংগ্রামের ধ্বংসাবশেষ খনন কাজের ফলে সেখানে ব্রঞ্জের বৌদ্ধমূর্তি পোড়া মাটির ফলকসহ বিভিন্ন মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু পাওয়া গিয়েছে।
বগুড়ায় এর প্রতিটি দর্শনী স্থানই ইতিহাস সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যশৈলীর। একেকটি অধ্যায়কে সঞ্চয় করে রেখেছে এই স্থানগুলো। দেখার মাধ্যমে শুধু স্থানীয় ইতিহাসের সাথেই পরিচিত হওয়া নয় বরং বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির একটি জীবন্ত চিত্রও পাওয়া যাবে। তাই সুযোগ করে বগুড়া জেলা ঘুরতে আসা উচিত।
পরিশেষেঃ বগুড়া জেলার শীর্ষ ৮ টি দর্শনীয় স্থান।
প্রিয় দর্শক: বগুড়া জেলায় শীর্ষ ৮ টি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আজকের এই আর্টিকেলটি আমরা আপনাদের জন্য তৈরি করেছি ,আশা করছি আপনারা এই আর্টিকেলটি পড়ে বগুড়া জেলা সম্পর্কে এবং বগুড়া এই ৮ টি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জানতে পেরেছেন । তাই আমাদের পোস্টটি যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না , কেননা আপনাদের কমিটি আমাদের উৎসাহিত করে ।